বন গিলে বন্যপ্রাণী রক্ষা কী করে সম্ভব?

কোথাও ভয়, কোথাও অজ্ঞতা, কোথাও আবার লোভের শিকার হচ্ছে বন্যপ্রাণী। ক্রমেই বিলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে একাধিক প্রজাতি। আবার ব্রিটিশ আমলের একটা সময় পর্যন্ত এ অঞ্চলের বনগুলো ছিল তৎকালীন রাজা-মহারাজা ও শাসকদের অবাধ মৃগয়া ক্ষেত্র। শখের বশে নিছক বিনোদনের জন্য তারা হত্যা করেছেন হাজার হাজার বাঘ, হাতি, হরিণ আর পাখি। তাই আজ পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের খেসারত দিতে হচ্ছে এই প্রজন্মকে।

আবার আমরাও সভ্যতার মেকি উন্নয়নযজ্ঞের ব্রতচারী। জল-জঙ্গল সর্বত্রই আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে গিয়ে ভুলতে বসেছি বিবর্তন আর বাস্তুতন্ত্রের মৌলিক সূত্রগুলো, যার বলি হচ্ছে শতশত নিরীহ বন্যপ্রাণ। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, একের পর এক প্রজাতি উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির অস্তিত্বও পড়ছে হুমকির মুখে। এভাবে চলতে থাকলে সে দিন আর বেশি দূরে নেই, ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ একটি সংকটাপন্ন প্রজাতি হিসেবে পরিগণিত হতে।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- বৈরী জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে ৭০৮ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টি, ৬৩২ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে আর ৩০ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ৪৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে আটটি এবং ১৬৭ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে বিলুপ্তির পথে ১৭টি। স্তন্যপায়ী ১২৭টি প্রজাতির মধ্যে ১২টি বিপন্ন আর ১৭টি বিলুপ্তির পথে। পাঁচ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ১০৬টির অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। ডাইনোসোরের মতো বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে বাঘ। প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৫০টি বাঘ কমে যাচ্ছে। 

উন্নয়নের বলি জীববৈচিত্র্য : বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ছিল গেল ৩ মার্চ। আন্তর্জাতিকভাবে এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল- ‘রিকভারিং কি স্পেসিস ফর ইকোসিস্টেম রিস্টোরেশন’; যার ভাবানুবাদ করা হয়েছে- ‘বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা করি, প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসি।’ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ দিবসের থিমটি জনসচেতনতা তৈরিতে যতটা প্রাসঙ্গিক, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ততটাই যেন ঢাল আছে তো তলোয়ার নেই এর মতো। তা ছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে এতো গভীরে গিয়ে ভাবার সময়টাই বা কই! যদিও জাতিসংঘ ২০২১-৩০ সময়কে প্রতিবেশ সংরক্ষণ দশক ঘোষণা করেছে, যার পুরো সময়টাই বিশ্বের দেশগুলোকে টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে; কিন্তু বাংলাদেশ যে প্রতিবেশ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে তা বুঝতে আর গবেষণার দরকার নেই, চারপাশে চোখ রাখলেই যথেষ্ট। 

এশিয়ান হাতির অন্যতম আবাসস্থল এবং প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের চুনতি অভয়ারণ্য বন ও পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় ২০১২ সালে জাতিসংঘের ‘ইকুয়েটর পুরস্কার’ লাভ করে। অথচ সেই অভয়ারণ্যের বুকচিরেই তৈরি করা হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ। কেটে ফেলা হচ্ছে বনটির শতবর্ষী গর্জনসহ লক্ষাধিক গাছ। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাছ কেটে রেলপথ তৈরির কারণে হুমকিতে পড়বে এ অভয়ারণ্যের বিশাল জীববৈচিত্র্য। প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলা ট্রেনে শব্দদূষণ ও ভীতির কারণে হারিয়ে যেতে পারে বিলুপ্তপ্রায় বহু পাখিসহ নানা বন্যপ্রাণ। অথচ এ অভয়ারণ্যকে রেহাই দিয়েও তৈরি করা যেত রেলপথটি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা ফিরোজ ১৯৯০ সাল থেকে চুনতি অভয়ারণ্য নিয়ে কাজ করছেন।

সরকারের রেল প্রকল্পটি সম্পর্কে এ গবেষক বলেন, ‘কোনো মতেই একটা অভয়ারণ্যের কোর জোন বা প্রধান অংশের ভেতর দিয়ে রেলপথ নিয়ে যাওয়া উচিত না। তার মধ্যে চুনতি অভয়ারণ্য হলো এশিয়ান হাতিসহ অন্যান্য প্রাণীর প্রধান আশ্রয়স্থল। তাই রেলপথটি চুনতি এলাকার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পূর্বদিকে নিয়ে গেলে অন্তত অভয়ারণ্যের পরিবেশ কিছুটা হলেও রক্ষা পেত। এতে করে ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেরও ব্যত্যয় ঘটতো না।’ এ ব্যাপারে পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। তবে সেটা নিশ্চয়ই বন ও পরিবেশ ধ্বংস করে নয়।’ 

বন ব্যবস্থাপনায় সাবেকি কাঠামো : ব্রিটিশ উত্তরাধিকার হিসেবে বন ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও পরিচালন কৌশল সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকলেও, সে বিষয়ে মাথা ঘামান না দায়িত্বপ্রাপ্তরা। বন ব্যবস্থাপনার সাবেকি কাঠামো ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে উল্টো বনের সহ-ব্যবস্থাপনাসহ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার নতুন কাঠামো, বিশেষত বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটগুলোর কার্যক্রম ঝুলে আছে। আর এ সুযোগে বেদখল হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বনভূমি।

বন অধিদপ্তরেরই তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত সংরক্ষিত বন জবরদখল হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর। যেখানে আইনি পদক্ষেপসহ উদ্ধারের জন্য উদ্যোগ রয়েছে কেবল ১২ হাজার ২১৪ একর বনভূমির। এসব নানা কারণেই বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক দুর্লভ বন্যপ্রাণী। শত বছরেই হারিয়েছে এক ডজনের বেশি বন্যপ্রাণ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- এক শিংবিশিষ্ট গণ্ডার, জাভান গণ্ডার, এশিয়ান দুই শিংবিশিষ্ট গণ্ডার, গাউর, বেন্টিং, বুনো মহিষ, নীলগাই, নেকড়ে, নুকতা হাঁস, ময়ূর ও কুমির। 

সৌন্দর্য হারাচ্ছে সুন্দরবন : বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সংরক্ষিত বনভূমির ৫১ শতাংশই সুন্দরবন। প্রায় ৬ হাজার ১১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ ম্যানগ্রোভে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুর, ধুধুঁল, হেঁতাল, শাল, সেগুনসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছ। বনের বুক ছিঁড়ে বয়ে চলা নদ-নদীতে বাস বিলুপ্তপ্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন ও ২১০ প্রজাতির মাছ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মায়াবী চিত্রা হরিণসহ ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজে ক্ষতি হয়ে এ বন মায়ের মতোই আগলে রাখে উপকূলবাসীকে; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে সুন্দরবনের পরিবেশ পরিস্থিতি। জলবায়ু পরিবর্তন, পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, বন্যপ্রাণী শিকার ও কাঠপাচারকারীদের কারণে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে এই বিশ্ব ঐতিহ্য।

বাঘের বিষয়ে বন বিভাগ থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের জরিপে সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল ছিল ৩৫০টি। ১৯৮২ সালের জরিপে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২৫টিতে। বনটির ১১০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১৯৮৪ সালে জরিপ চালিয়ে ৪৩০ থেকে ৪৫০টি বাঘ থাকার কথা জানানো হয়। আর ২০১৫ সালে ‘ক্যামেরা ট্র্যাকিং’ পদ্ধতিতে জরিপে জানা যায়, বাঘের সংখ্যা মাত্র ১০৬টি। পরে ২০১৮ সালের জরিপে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ রয়েছে বলে জানানো হয়। দেড় লাখ থেকে হরিণের সংখ্যাও নেমে এসেছে ৫০ হাজারে। বেপরোয়া শিকারিরা ফাঁদ পেতে ও গুলিতে শিকার করে চলেছে চিত্রা ও মায়া হরিণ। পরে সেই মাংস, মাথা, শিং বিক্রি করা হয় সুন্দরবন সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকায়। অনেকে ধরাও পড়ে। গত এক বছরে সুন্দরবনের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ১০ হরিণ শিকারিকে মাংসসহ আটক করা হয়েছে।

সবশেষ ৯ ফেব্রুয়ারি মোংলা উপজেলার ডাংমারি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪২ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে কোস্টগার্ড। অপরদিকে বিষ দিয়ে শিকার বন্ধ করতে না পারায় মৎস্য ভাণ্ডারখ্যাত সন্দুরবনের নদী-খাল ক্রমশ মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে। এখন আর তেমন চোখে পড়ে না রয়না, কালো হাঙ্গর, তীরন্দাজ, জাভা, কাইক্কা, কাজলী, শিলং, কাইন মাগুর, দাতিনা, লাক্ষাসহ ১৫-২০ প্রজাতির মাছ। বিষে কেবল মাছ-ই নয়, মারা যাচ্ছে জলজ অন্যান্য প্রাণীও। ষাট ও সত্তরের দশকে সুন্দরবন-সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষ কুমিরের ভয়ে নদীতে গোসল করতে নামত না। তখনকার হিসাব অনুসারে, ওই বনে নোনাপানির কুমিরের সংখ্যা ছিল দেড় হাজারেরও বেশি। এখন তা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ২০০-২৫০টিতে। পাখির মধ্যে সাদা মানিকজোড়, কানঠুনি, বোঁচা হাঁস, গগণবেড়, জলার তিতিরসহ অন্তত ১৫টি প্রজাতি আর কোনোদিন সুন্দরবনে দেখা যাবে কি-না সন্দেহ। 

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘সুন্দরবনের সৌন্দর্য হলো বন্যপ্রাণী; কিন্তু সেই বনকেই ধ্বংসের মুখে ফেলে দিলে এসব প্রাণের অস্তিত্ব টিকবে কী করে? বন্যপ্রাণী যারা নিধন করে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন করার দাবি জানিয়ে আসছি অনেক দিন ধরেই। কে শোনে কার কথা! তাই প্রচলিত আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে অপরাধীরা পুনরায় সুন্দরবনে বন্যপ্রাণ নিধনে লিপ্ত হয়।’ 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘সুন্দরবনে বহু দিন ধরেই চলছে অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন। নিয়মিতভাবে এসব গাছ কাটার ফলে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য আজ বিপন্ন। আর এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই হয়তো এটি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে। এরই মধ্যে হাতে হাতে মিলছে এর ফল। ওই অঞ্চলে আছড়ে পড়ছে একের পর এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের জেরে জলোচ্ছ্বাসও বাড়ছে।’

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন অবশ্য বলেন, ‘বনের মধ্যে যে কোনো অপরাধ আমরা কঠোরভাবে দমন করি। এমনকি সুন্দরবন সুরক্ষা করতে বনসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের বিভিন্নভাবে সচেতনও করা হচ্ছে, যাতে এ বনের ওপরে কোনো বিরূপ প্রভাব না পড়ে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //